নিজস্ব সংবাদ ডেস্কঃ মানবসেবা সংবাদ টুইন্টিফোর ব্লগস্পট ডটকমঃ
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস বেশ কিছুদিন ধরেই করোনা টিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছেন। ড. ইউনূস করোনার টিকাকে গ্লোবাল কমন গুডস ঘোষণার দাবী জানিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে একটি আবেদন জানিয়ে আসছেন। ড. ইউনূসের দাবীকৃত গ্লোবাল কমন গুডস এর মানে হলো উৎপাদিক এই টিকাকে ব্যক্তি মালিকানার আওতা বহির্ভূত রাখা। সহজ কথায় টিকার কোনো প্যাটেন্ট রাইট থাকবে না এবং টিকা বানানোর সূত্রটি উন্মুক্ত থাকবে। এতে পৃথিবীর যেকোন রাষ্ট্রই ইচ্ছা ও প্রয়োজন অনুযায়ী টিকা তৈরি করতে পারবে। এর জন্য আবিষ্কারক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র অন্যের কাছ থেকে বাড়তি মুনাফা অর্জন করতে পারবে না। বর্তমান পুজিবাদী বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই দাবীকে অভিনব মনে হলেও বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়; এমনকি বিরলও নয়। আজ থেকে প্রায় ১২৩ বছর আগে বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী তাঁর নিজের আবিষ্কৃত যন্ত্রের প্যাটেন্টমুক্ত করে বিশ^বাসীর কাছে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। এই বিজ্ঞানীর নাম জগদীশচন্দ্র বসু। আমরা জানি জগদীশ বসু মাইক্রোওয়েভ আবিষ্কার করেন। ১৮৯৫ সালে কলকাতায় তিনি এর প্রথম প্রদর্শন করেন। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তিনি এর প্রদর্শন করেন। জগদীশ বসুর এই আবিষ্কারের প্রভাব এবং তাৎপর্য ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল, রাডার প্রযুক্তিসহ বর্তমান বিশে^র অনেক আধুনিক প্রযুক্তির পেছনে বুনিয়াদ হিসেবে রয়েছে জগদীশ বসুর এই আবিষ্কার। মাইক্রোওয়েভ ছাড়াও জগদীশ বসু পদার্থবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রায় দুই শতাধিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেন। কিন্তু তিনি তাঁর আবিষ্কারের প্যাটেন্ট নেন নি। জগদীশ বসু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্যাটেন্ট নেয়ার পক্ষে ছিলেন না। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে তিনি ব্যাক্তিমালিকানা বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার উর্ধ্বে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল লক্ষ্য মানকলাণ, মুনাফা নয়। কিন্তু প্যাটেন্টের নামে পাশ্চাত্য সমাজ বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। পাশ্চাত্যের এই অর্থলোভী মানসিকতাকে জগদীশ বসু মনে মনে ঘৃণা করতেন। বন্ধু রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা এক পত্র থেকে বিজ্ঞানীর এমন মানসিকতার ধারণা পাওয়া যায়। ১৯০১ সালে বন্ধু রবীবন্দ্রনাথের কাছে লেখা একটি পত্রে জগদীশ বসু লিখেন- ‘আমার বক্তৃতার কিয়ৎক্ষণ পূর্বে একজন অতি বিখ্যাত টেলিগ্রাফ কোম্পানির ক্রোড়পতি প্রোপ্রাইটার টেলিগ্রাফ করিয়া পাঠাইলেন, দেখা করিবার বিশেষ দরকার; আমি লিখিলাম সময় নাই, তার উত্তরে পাইলাম আমি নিজেই আসিতেছি। অল্পক্ষণের মধ্যেই স্বয়ং উপস্থিত। হাতে patent form। আমাকে বিশেষ অনুরোধ করিলেন, আপনি আজ বক্তৃতায় সব কথা খুলিয়া বলিবেন না। There is mony in it, let me take out patent for you. You do not know what money you are throwing away ইত্যাদি। এই ক্রোড়পতি আর কিছু লাভ করিবার জন্য আমার নিকট ভিক্ষুকের ন্যায় আসিয়াছে। বন্ধু, তুমি যদি এ দেশের টাকার উপর মায়া দেখিতে- টাকা-টাকা- কী ভয়ানক সর্বগ্রাসী লোভ!’ জগদীশ বসুর আবিষ্কার কতটা সুদূরপ্রসারী তা ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা বুঝতে পেরেছিলেন। একারণেই তারা জগদীশ বসুর জন্য প্যাটেন্ট ফরম নিয়া তার কাছে এসেছিলেন। জগদীশ বসুকে অর্থলোভ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু জগদীশ বসু এই লোভের ফাঁদে পা দেন নি। ১৯০১ সালের ২২ শে মে মাসে জগদীশ আরেক পত্রে রবীন্দ্রনাথকে লিখেন ‘সেদিন যে আমার জন্য প্যাটেন্ট লইবার জন্য একজন বন্ধু আসিয়াছিলেন তিনি রাগ করিয়া গিয়াছিলেন এত সময় নষ্ট করিয়া আপনাকে ংবৎাব করিবার জন্য আসিয়াছিলাম, আপনি কিছু করিলেন না। I do not want to have anything more to do with it. Lecture এর পর আবার লিখিয়াছেন I want to serve again. বন্ধু আমি যেন এই commercial spirit হইতে উদ্ধার পাইতে পারি।’ জগদীশ বসু বিজ্ঞানকে বাণিজ্যিক লাভালাভের বিষয় হিসেবে মনে করতেন না। বরং তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্যই হবে মানবকল্যাণ। এই কারণে জগদীশ বসু তার কোনো আবিষ্কারের জন্য প্যাটেন্ট গ্রহণে সম্মত ছিলেন না। ভগিনী নিবেদিতার পীড়াপীড়িতে একটি যন্ত্রের প্যাটেন্ট নিয়েও তিনি তা আর নবায়ন করেন নি। বিজ্ঞানের দুনিয়া বিজ্ঞানী জগদীশ বসুর এই নৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে পারে নি। বরং বর্তমান বিশ্বে জগদীশ বসুর এই বিজ্ঞান দর্শন থেকে স্খলিত হয়ে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন বিজ্ঞানের যেকোনো আবিষ্কারের জন্য মানব কল্যাণের চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থটাই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। বিজ্ঞান অর্থের এখন অনুগত হয়ে গেছে, মুনাফা এখন বিজ্ঞানকে পরিচালিত করছে। অর্থই বিজ্ঞানের গতিপথ নির্দেশ করছে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এখন মানব কল্যাণের পরিবর্তে মানবশোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। জগদীশ বসুর এই প্যাটেন্ট বিরোধী মনোভাব কেবল মানহিতৈষী অবস্থান থেকে উদ্ভুত নয়। বরং একজন এটাই হওয়া উচিত একজন প্রকৃত বিজ্ঞানীর ন্যায্য অবস্থান। কারণ, বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কারই সম্পূর্ণরূপে পরম্পরামুক্ত স্বতন্ত্র আবিষ্কার নয়। বরং প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনেই রয়েছে জানা না-জানা অনেক সফল কিংবা ব্যর্থ প্রচেষ্টার ভুমিকা রয়েছে। সকল আবিষ্কারের পেছনেই রয়েছে তার পূর্বসূরীদের অবদান। এমনকি প্রত্যেকটি সফলতার পেছনেই রয়েছে ব্যর্থতারও কিছুটা অবদান। অনেক বিজ্ঞানীই তা স্বীকার করেছেন। বিজ্ঞানী নিউটন সেই অবদান স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি অন্যের চেয়ে কিছুটা বেশি দেখ তবে তা অবশ্যই অন্যের ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে।’ কাজেই অনেকের অবদানে অর্জিত সাফল্যের মুনাফা এককভাবে কেউ পেতে পারে না। জগদীশ বসুর মতো এখনও অনেকেই মনে করেন বিজ্ঞানের সকল আবিষ্কারই প্যাটেন্ট মুক্ত থাকা উচিত। কারণ তথাকথিত প্যাটেন্ট অধিকার মানব কল্যাণে যতটা না উপকার করছে, ক্ষতি করছে তার চেয়ে অনেক বেশি। পুজিবাদী যুগে প্যাটেন্ট অনেকটা অস্ত্রের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্যাটেন্ট অধিকার ধনী দরিদ্র রাষ্ট্রের মধ্যে বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়; ধনীকে আরো ধনী করে, গরীবকে আরো গরীব করে। করোনার মতো মহামারীর টিকা বা ভ্যাকসিন যদি এই মুনাফার খপ্পড়ে পরে তাহলে মানব ইতিহাসে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সঠিকভাবেই এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি করোনার টিকাকে গ্লোবাল কমন গুডস ঘোষণা করার দাবী জানিয়েছেন। যেকোনো চিন্তাশীল মানুষই বুঝতে পারছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই দাবী কতটা প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের নোবেল বিজয়ী, রাষ্ট্রপ্রধান ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ তাঁর এই আবেদনে ইতোমধ্যেই সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু সফলতা বলতে যা বোঝায় তা এখনও আসে নি। অর্থাৎ, এখনও করোনার টিকাকে গ্লোবাল কমন গুডস ঘোষণা করা হয় নি। বরং দেশে দেশে করোনার টিকা নিয়ে স্বার্থপরতা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এবং এই ধারা অব্যহত থাকলে তা মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে স্বার্থপরতার নজির হয়ে থাকবে। কাজেই আগামীর মানুষের কাছে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে হলে আজকের মানুষের সুবোধ ও সুচিন্তা জরুরি। সবচেয়ে বেশি জরুরি ন্যয়বোধ। করোনার টিকাকে প্যাটেন্ট-এর আওতামুক্ত রেখে একে গ্লোবল কমন গুডস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আজকের বিশ্ব কি আগামী প্রজন্মের কাছে শ্রদ্ধার্ঘ হয়ে থাকতে পারবে-এই প্রশ্ন এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এম.এস.24.বি.ডটকম
এই পত্রিকার আরো সংবাদ পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুনঃ
0 komentar: