উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিকে (নেপ) একত্রিত করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ নামে একটি অধিদপ্তর স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী এই তিন শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটবে। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর গত ৪ জানুয়ারি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে অধিদপ্তর সৃষ্টির জন্য মতামতও চেয়েছে মন্ত্রণালয়। এমন খবরে প্রাথমিক শিক্ষার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষার তিনটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে হঠাৎ বিলুপ্তি ঘটিয়ে নতুন একটি অধিদপ্তর সৃষ্টির বিষয়কে ভালো চোখে দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রাথমিক শিক্ষার কর্মকর্তাদের ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ করে আমলাদের পুনর্বাসনের জন্য নয়া এই অধিদপ্তর গঠন করা হচ্ছে। এতে বর্তমানে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিভেদ আরো বাড়বে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে তারা কিছুই বলতে রাজি হচ্ছেন না। তারা পুরো বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রেখেছেন। পাশাপাশি বর্তমানে সংকটের সময় এমন বিলাসি অধিদপ্তর গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, পুরো বিষয়টি আমি জানি। এটি একটি বিশদ আলোচনার বিষয়। আমার জনসংযোগ কর্মকর্তাকে বলুন, তিনি এ বিষয়ে আমার (মন্ত্রী) কাছে নথি উত্থাপন করবেন। এরপরে আপনাকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বলব।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধূরি বলেন, বর্তমান প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোকে জোরদার না করে নতুন অধিদপ্তরের জন্ম দেয়াটা বোধগম্য হচ্ছে না।
প্রশিক্ষণের জন্য নবসৃষ্ট অধিদপ্তরকে ভালো মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেছেন, বর্তমানে তিনটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে তিন রকমের নির্দেশনা যায়। আবার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা নির্দেশনা দেয়। এতে অনেক সময় দ্বিধাদ্ব›দ্ব হয়। এখন দেখতে হবে প্রশিক্ষণের জন্য গঠিত নতুন অধিদপ্তর থেকে এ রকম ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা যায় কিনা। যদি ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা যায় তাহলে আমি বলব, এগুলো বাদ দিতে হবে। আর প্রশিক্ষণ অধিদপ্তর থেকে যদি এক নির্দেশনায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সবকিছু জানানো হয় তাহলে আমি বলব, সরকারের এই উদ্যোগ ঠিক আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ৪ জানুয়ারি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠায়। এতে বলা হয়, ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গত ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিকে (নেপ) একত্রিত করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট সৃষ্টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এমতাবস্থায় ইউআরসি, পিটিআই এবং নেপকে একত্রিত করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ অধিদপ্তর সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে পাঠাতে হবে।’
জানতে চাইলে নেপের মহাপরিচালক মো. শাহ আলম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ঢাকা পিটিআইয়ের সুপারিয়েনটেনডেন্ট মো. কামরুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, কর্তৃপক্ষ কেন এমনটি করতে চাইছে তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরের গঠন নিয়ে তাদের দুই রকম চিন্তা হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে, বর্তমানে থাকা তিন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান একত্রিত করার ফলে যদি পদ-পদবী বাড়ে তাহলে মন্দ হবে না। অন্যদিকে, নতুন অধিদপ্তর সৃষ্টি করে তার মাথায় আমলাদের বসিয়ে দিলে বিষয়টির অন্য রকম মাত্রা পাবে। কাজেই আরো কদিন না গেলে বিস্তারিত ব্যাখা দেয়া যাবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের ইউআরসি থেকে প্রশিক্ষণ হয়। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ডিপিইনএড প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে জেলা সদরে অবস্থিত পিটিআই। আর প্রশিক্ষণের সবকিছুর দেখভাল করে ময়মনসিংহে অবস্থিত নেপ। আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রশিক্ষণের বিধান দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরও। নয়া বিধানমতে, প্রাথমিকের শিক্ষা প্রশিক্ষণ নামে অধিদপ্তর সৃষ্টি হলে বর্তমানে থাকা কর্মকর্তাদের কী হবে? উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে কী হবে? এসবের উত্তর এখনো মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তাই দিতে চাচ্ছেন না। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আমিনুল ইসলাম খান এই তত্ত্বের জনক। তিনিই বর্তমানে থাকা তিনটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে প্রশিক্ষণের নামে একটি অধিদপ্তর সৃষ্টির বিষয়টি চূড়ান্ত করেন। তার দেখানো পথেই মন্ত্রণালয়ের বর্তমান প্রশাসন নতুন অধিদপ্তর গঠন করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। নতুন অধিদপ্তরে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা মহাপরিচালক হবেন। একই মানের আরেকজন কর্মকর্তা অতিরিক্ত মহাপরিচালক হবেন। যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা পরিচালক পদের জন্য পদায়ন পাবেন। বর্তমানে নেপ, পিটিআই এবং রিসোর্স সেন্টারের কর্মরতরা কোথায় কিভাবে প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরে সংযুক্ত হবেন তার রূপরেখা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
তিনি বলেন, নেপে বর্তমানে মহাপরিচালক ও পরিচালক পদে আমলারা পদায়ন পাচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে আমলার রয়েছেন। নবগঠিত প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরে আমলারা পদায়ন পাবেন। প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরের জন্য রাজধানীর মিরপুরে একটি ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পিটিআই সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর এর মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। শিক্ষক তৈরির দক্ষ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পিটিআই। তারা বলেন, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১২টি জেলায় আগে পিটিআই ছিল না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ১২টি জেলাসহ দেশের সব জেলায় পিটিআইতে নতুন ভবন নির্মাণ করেন। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে সবগুলো প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সমৃদ্ধ হয়েছে। এখন এই অভাবের বাজারে এগুলোকে বিলুপ্তি করে নতুন প্রশিক্ষণ অধিদপ্তর গঠন করে কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা বিশ্লেষণ করার দাবি জানিয়েছেন দেশের একাধিক জেলার পিটিআই সুপার।
সুত্রঃ ভোরের কাগজ
0 komentar: